শেরপুরের ছেলে সুমনের ড্রোন বানিয়ে, ইউটিউব বাজিমাত করে চমক সৃষ্টি
মইনুল হোসেন প্লাবন, শেরপুর : জীবনে বড় হতে হলে স্বপ্নবাজ হওয়া খুবই জরুরী। বাবার টাকায় বড় হওয়া আর শুন্য হাতে স্বপ্ন লালন করে বড় হওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। সমাজের শ্রেনী বিভক্তির জায়গা থেকে একটি নিন্মবিত্ত বা মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানকে কতটা ভাল থাকার অভিনয় করতে হয়, তা একমাত্র ভুক্তভোগিই জানে। এদিকে আবার সবচেয়ে হতাশার মধ্যে তারাই ডুবে থাকে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে যাদের জন্ম নয় তারা যে জীবনে বড় কিছু করবে না তাও কিন্তু নয়। যারা জীবনে বড় হয়েছে তারা তাদের স্বপ্নকে লক্ষ ধরে নিয়েই কাজ করেছে। সেই সাথে পরিশ্রম আর লেগে থাকার বিনিময়ে সফলতাও পেয়েছে। জীবনে বড় হতে হতে হলে অনেক শিক্ষিত হতে হবে এমন কথাও কোথায় নেই। অনেক সল্প শিক্ষিত ঝরে পড়া ষ্টুডেন্টও জীবনে বড় কিছু করেছে। কারণ তাদের স্বপ্ন আর আত্মবিশ্বাস ছিল আকাশের ওপারে। বিল গেটস, মার্ক জুকারবার্গ, স্টিভ জবস – এই ৩ জনের মধ্যে দারুণ একটা মিল রয়েছে। তারা ৩ জনই ইউনিভার্সিটি ড্রপ আউট স্টুডেন্ট। জুকারবার্গের তাও ব্যাচেলর ডিগ্রি আছে, অন্য ২ জনের তাও নেই। এদের প্রত্যেকের সফলতার পেছনে ছিল জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন।
এমনই এক বিস্ময়কর স্বপ্নবাজ তরুণ সুমন; যার পুরো নাম- মোঃ সুমন ইসলাম। কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী সুমনের কোন কারিগরি শিক্ষা না থাকলেও সে নিজের উদ্ভাবনী ও মেধা শক্তি কাজে লাগিয়ে ড্রোনসহ নানা ইলেকট্রিক সামগ্রী বানিয়ে এবং সেগুলোর ভিডিও ইউটিউব চ্যানেলে ছেড়ে এখন শেরপুরের এক বিস্ময়কর স্বপ্নবাজ তরুণ হিসেবে পরিচিত। সেইসাথে সে এখন আলোচিত ইউটিউবার ও ইউটিউব চ্যানেল ‘ক্রেজি থিঙ্ক’ (crazy think) এর জনক। অন্যদিকে ড্রোন বানিয়ে চমক সৃষ্টির পাশাপাশি ইউটিউবেই সে বাজিমাত করে ঘরে বসেই মাসে আয় করছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। সচেতন মহলের ধারণা, তাকে কারিগরি সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হলে সে অচিরেই হয়ে উঠতে পারে একজন সেরা ইউটিউবার। সেইসাথে দেশের লাখ লাখ বেকার তরুণ-যুবকদের জন্য হয়ে উঠতে পারে এক অনুকরণীয়-অনন্য দৃষ্টান্ত।
জানা যায়, শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত পল্লী পশ্চিম কুমড়ি গ্রামের দুলাল মিয়া ও সমতা বানুর ছেলে সুমন ইসলাম। সে ৩ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তৃতীয়। সুমন গত বছর এইচএসসি পাসের পর এবার স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে শেরপুর সরকারি কলেজে। পিতা হতদরিদ্র রিক্সাচালক হওয়ায় সে নিজ এলাকাসহ আশেপাশের এলাকায় বিভিন্ন বাসাবাড়িতে বৈদ্যুতিক কাজ করার পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিল। এরপরও ছোট থেকেই বৈদ্যুতিক খুটিনাটি বিষয়ে নাড়াচাড়াসহ নতুন কিছু তৈরি বা উদ্ভাবনের প্রবল ইচ্ছা তার মধ্যে কাজ করছিল। অনেকটা সাদামাটা জীবনযাপনের মাঝেই সুমন ‘বিস্ময়কর’ কিছু কাজ করে চমকে দিয়েছেন সবাইকে। ইতোমধ্যে ৬ শতাধিক যন্ত্রপাতি তৈরির ভিডিও তিনি ছেড়েছেন ইউটিউব চ্যানেলে। প্রতিনিয়ত সে নতুন কিছু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য বাড়ছে তার পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা। এখন তার গড় মাসিক আয় ৭০/৮০ হাজার টাকা। আর ওই আয় করা সম্ভব হচ্ছে তার কোন কারিগরি শিক্ষা বা প্রশিক্ষণে নয়, তার অবলম্বন ইউটিউবই। ইউটিউবে বিভিন্ন সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি তৈরির প্রযুক্তি দেখে সুমন নিজে নিজেই শিখেছে কৌশল। ক্যামেরাসহ ড্রোন, ফ্যান, রিচার্জেবল হট এয়ারগান, রিচার্জেবল পাওয়ারফুল এয়ারকুলার, ওয়্যারলেস, সিসিটিভি ক্যামেরা, ফ্লাইং হেলিকপ্টার, ৫ ধরনের এয়ারফোন, সিম ছাড়া ওয়াইফাই রাউটার, পাওয়ারফুল ওয়াটার পাম্প, হ্যান্ড কন্ট্রোল আরসি ড্রোনসহ অসংখ্য ইলেকট্রনিক সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে নিজেই। পুরাতন ফেলে দেয়া ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশ, কাগজ, গাম, আর কিছু নতুন যন্ত্রাংশ ব্যবহারে তৈরি করেছে নানা আকর্ষণীয় খেলনা, ব্যবহার্য সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি। ওইসব যন্ত্রপাতি হাতেকলমে তৈরির ভিডিও ধারণ করে সেগুলো নিজের ইউটিউব চ্যানেলে ছেড়ে দিয়ে প্রতি মাসে আয় করছে সুমন।
সরেজমিনে গেলে কথা হয় ইউটিউবার সুমন ইসলামের সাথে। সে জানায়, বাবা অনেক কষ্ট করে আয় করতেন। আমরা একটা ঝুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে থাকতাম। একপর্যায়ে আমি বৈদ্যুতিক মিস্ত্রির কাজ শুরু করি। এসএসসি পাস করার পর শেরপুরের ডা. সেকান্দর আলী কলেজে ভর্তি হলে সেখানে ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধা পাই ওয়াইফাই লাইনের মাধ্যমে। তখন ইউটিউবে ঢুকে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরির ভিডিও দেখি। একসময় আমিও বিভিন্ন যন্ত্র তৈরি শুরু করি। সে জানায়, প্রথমে খালি ম্যাচের প্যাকেট দিয়ে একটি এয়ারকপ্টার তৈরি করে ইউটিউবে দিই। এটিতে ব্যাপক সাড়া পড়ে, ভিডিওটিতে প্রায় ৯ কোটি ভিউ হয়। ৬ শতাধিক যন্ত্রপাতি তৈরির ভিডিও আমি ইউটিউবে ছেড়েছি। বর্তমানে আমার ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার ৬ লাখের কাছাকাছি। মাসে ইউটিউব থেকে আয় হয় ৭০/৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আমাদের সংসারে এখন আর আগের মতো অভাব নেই। সুমন আরও জানায়, আমি একটি ড্রোন বানিয়েছি, যা অনেক উঁচুতে এবং দূরত্বে যেতে পারে। আমি দেশের সবচেয়ে বেশি ওজনবাহী একটি ড্রোন তৈরি করতে চাই। ওই ড্রোন মশা নিধনে কীটনাশক ছিটাতে পারবে। এ ছাড়া ড্রোনটি বিভিন্ন ধরনের তথ্যচিত্র ধারণ করতে পারবে। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে সে জানায়, সে একজন সেরা ইউটিউবার হতে চায়।
সুমনের বাবা দুলাল মিয়া বলেন, আমি অনেক কষ্ট করে রিকশা চালাইতাম, এহন আমার ব্যাটারিচালিত অটোগাড়ি। এহন আমার ভাঙা ঝুপড়ি ঘর নাই, পাক্কা ঘরে থাহি। সবকিছুই সম্ভব অইছে আমার পোলার জন্য। আর মা সমতা বানু বলেন, একসময় আমরা অনেক কষ্ট করছি। ভাবি নাই আমার পোলা সুমন গরিব ঘরে থাইক্কা এত কিছু করব। এহন আমার পোলারে নিয়া গর্ব অয় আমগো। স্থানীয় কিশোর মোশারফ জানায়, ড্রোন তো আমি জীবনে দেখি নাই। সুমন ভাই বানাইছে। তাই দেখবার আইছি। এইডা আকাশে এত উপরে উঠে যে, পরে তা তাকিয়ে থেকেও দেখা যায় না!
বাজিতখিলা ইউপি চেয়ারম্যান আমির আলী সরকার বলেন, সুমনের মধ্যে বড় হওয়ার আকাক্সক্ষা আছে। তাকে সরকারিভাবে সহায়তা করলে সে সামনের দিকে আরও এগিয়ে যাবে। দেশকে অবাক করার মতো আরও নতুন কিছু উপহার দেবে।
এ ব্যাপারে শেরপুরের জেলা প্রশাসক আনার কলি মাহবুব দরিদ্র পরিবারের সন্তান সুমনের ড্রোন তৈরি ও ইউটিউবে মাসিক আয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, তার মতো মেধাবীদের জন্য জেলা প্রশাসনের সহযোগিতার দুয়ার সবসময় খোলা। সে আমাদের বেকার তরুণ-যুবকদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। কাজেই তাকেও দেওয়া হবে প্রয়োজনীয় সহায়তা।