করোনার মাঝেও সরেজমিন পর্যবেক্ষণে গেলাম
তালাত মাহমুদ :
২১ এপ্রিল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টা বাসা থেকে বের হয়েছি নকলা ও চন্দ্রকোনা যাওয়ার উদ্দেশ্যে। শেরপুর টাউনের নবীনগরস্থ হাজীর মোড় থেকে একটি অটোরিক্সা রিজার্ভ করে নকলা ও চন্দ্রকোনায় বিরাজমান জনপরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য যাত্রা করি। শেরপুর-ময়মনসিংহ ফিডার রোড, পরিচ্ছন্ন এবং প্রশস্ত। অনেকটা ফাঁকা। আমাকে বয়ে নিয়ে অটোরিক্সাটি চলতে শুরু করলো। মাঝে মধ্যে দু’একটি মালবোঝাই ট্রাক, পিকআপ, জরুরী অষুধ সরবরাহের কভার্ডভ্যান যাওয়াআসা করছে। কম সংখ্যক অটোরিক্সাও চলাচল করছে। হঠাৎ দু’একটা সিএনজিরও দেখা মিললো।
রাস্তার দু’পাশে বোরধানের ক্ষেত। আর মাত্র ১৫ দিন বাকি; ধান কাটার ধুম পড়ে যাবে। কিন্তু কৃষকের মাথায় হাত। ধান কাটার শ্রমিক কোথায় পাবে? করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে অবরুদ্ধ সবাই। তাই তীব্র শ্রমিক সঙ্কট চলছে। কিছু কিছু জমিতে আগাম ধান কাটা লেগেছে। প্রতিবারের মতো এবারও বিডি ক্লিনের সোনার ছেলেরা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে কৃষকদের ধান কাটতে মাঠে নেমেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বোচ্ছাসেবক লীগের কর্মীরা বিনা পারিশ্রমিকে কৃষকদের ধান কাটতে শুরু করেছে।
মনে পড়ে, ছাত্র জীবনে আমরাও স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে খাল খনন করেছিলাম। সেটা ১৯৭৭-৭৮ খ্রিস্টাব্দের কথা। তখন জিয়াউর রহমানের ‘খাল থনন কর্মসূচী’র মাধ্যমে স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার প্রক্রিয়া চলছিল। সেচ ব্যবস্থা চালু করে বোরধানের আবাদ বৃদ্ধি করতে উদ্যোগটি নেয়া হয়েছিলো। আর এতে কলেজ ও স্কুলের ছাত্রদের সম্পৃক্ত করা হয়েছিল।
আমাকে বয়ে নিয়ে চলা অটোরিক্সাটি পিচঢালা পথ বেয়ে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দু’পাশের নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। কোন সাড়া শব্দ নেই। জনবিরল এমন দৃশ্য জীবনেও দেখিনি। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, ইতিহাসে বিশ^যুদ্ধের বর্ণনা পড়েছি: কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে এমন উদ্ভুত পরিস্থিতি আগে কখনো দেখিনি, কখনো শুনিও’নি। গণপদ্দী ইউপি’র কৈয়ার বাজারে ঢুকলে আগে অন্তত ১৫/২০ টি সালাম পেতাম। আর এখন সালাম নেয়ারও লোক নেই।
‘করোনা’ কী এমন ক্ষমতা তোর! যে ক্ষমতাবলে আজ গোটা বিশ^কে তুই স্তব্ধ করে দিয়েছিস! লাখ লাখ অসহায় মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছিস! বিশে^র সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রকেও পর্যুদস্ত করে ফেলেছিস! চীন, রাশিয়া, ভারত, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, জার্মান, ইতালী, তুরস্ক, বৃটেন, ইসরায়েল, মিশর সহ আরও অনেক উন্নত রাষ্ট্র তাদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়েও তোকে মোকাবিলা করতে পারছে না। হে পরম সৃষ্টিকর্তা, তোমার আশরাফুল মাখলুকাতকে এভাবে পরাজিত হতে দিও না। ‘তুমি এক এবং অদ্বিতীয়। তুমি ছাড়া আমাদের আর কোন মা’বুদ নেই। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তোমার প্রেরিত রাসুল’। করোনা’র কবল থেকে তুমি আমাদের রক্ষা কর।
আমাকে বয়ে নিয়ে আসা অটোরিক্সাটি ততক্ষণে সোনালী ব্যাংক, নকলা শাখা কার্যালয়ের সামনে এসে হাজির। রিক্সাচালকের ডাকে আমার সম্বিত ফিরে আসে। আমি রিক্সা থেকে নেমে ব্যাংকে প্রবেশ করলাম। সেখানে প্রবীন সাংবাদিক মুহম্মদ হ্রুন অর রশিদের সাথে দেখা। টাকা উঠাতে এসেছেন। আমি একটি চেকবই উত্তোলন করে বেরিয়ে এলাম। এবার চন্দ্রকোনায় যাবার পালা।
নকলা উপজেলা পরিষদের গেট থেকে চন্দ্রকোণার দূরত্ব সাড়ে ৭ কিলোমিটার। চলাচল অনোপযোগী রাস্তাটি দেখার কেউ নেই। এবড়ো থেবড়ো এ রাস্তা দিয়ে চলাচল রত যানবাহনে যদি কোন গর্ভবতী মহিলা যাতায়াত করেন তাহলে এক ঝাকুনিতেই তার সন্তান প্রসব হয়ে যেতে পারে। অথবা সদ্য সন্তান সম্ভবাদের গর্ভপাত ঘটতে পারে। এ রাস্তাটি এখন মরণ ফাঁদ। আমার মত অসুস্থ মানুষের জন্য যাতায়াত করা সম্পূর্ণ নিসিদ্ধ।
অনেক কষ্টে চন্দ্রকোনা গিয়ে পৌঁছলাম। চৌমুহনীতে লোক সমাগম দেখে বোঝার উপায় নেই যে, দেশে করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক চলছে। রাস্তায় রিক্সা, ভ্যানগাড়ি, অটো, মোটর সাইকেল, পথচারি সেই আগের মতই চলাচল করছে। চন্দ্রকোণায় পুলিশ ফাঁড়ি থাকলেও বাইরে কর্তব্যরত অবস্থায় কোন পুলিশ কনস্টেবলের দেখা পাইনি। ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখলাম সচিব সাহেব ক’জন সহকর্মী নিয়ে দুঃস্থ মহিলাদের ভিজিডির চাল দিচ্ছেন। চেয়ারম্যান আবু সাঈদ সিদ্দিকী আমার অনুজ। করোনার প্রভাব ও ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে তার সাক্ষাৎ প্রয়োজন। কিন্তু তিনি ‘মাটি’ নামে একটি এনজিও অফিসে ত্রাণ বিতরণ করতে গেছেন। কি আর করা অগত্তা কিছুটা সময় অপেক্ষায় থেকে নকলার উদ্দেশ্যে ফিরতে হলো।
সেই এবড়ো থেবড়ো রাস্তা। মনে হলো এই বুঝি রিক্সাটি উল্টে গেল। ঝাকুনিতে মেরুদন্ডের হাঁড় চটকে যাওয়ার অবস্থা। কায়দা নামক স্থানে আসতেই বড় এক ঝাকুনিতে রিক্সার মটর বন্ধ হয়ে গেল। চালক কোন মতে রিক্সাটি মাইল খানেক টেনে নিয়ে নকলা থানার দক্ষিণ কোণে এক মেকারকে দেখাল। গণপদ্দী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলহাজ মোঃ শামসুর রহমান আবুলের সাথে দেখা হলো। তিনি মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে চলে গেলেন। এরপর এএসপি সার্কেল আমিনুল ইসলাম সাবেবের গাড়িটি পাশ কেটে গেল। তখন বেলা ২টা। পুলিশ মাইকে দোকানপাট বন্ধ করার ঘোষণা দিচ্ছে। অষুধের ফার্মেসি আর সারের দোকান ব্যতীত সব দোকান মূহুর্তের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল। মেকার কিছুক্ষণ চেষ্টা করে মটর চালু করতে অপারগতা প্রকাশ করল। রিক্সাচালক অগত্তা রিক্সা টেনে নিয়ে শেরপুরের পথে পা বাড়ালো।
আর আমি হেঁটে নকলা উত্তর বাজার এসে দু’একজন ব্যক্তির কাছে নকলার উত্তরাঞ্চলের বোর ধানের আবাদের খোঁজ নিলাম। দু’এক বছর পরপর ঐ এলাকায় শিলাবৃষ্টিতে বোরধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে। নকলা থেকে তারাকান্দি পর্যন্ত রিক্সা ভাড়া করে যাত্রা করলাম। জালালপুরে এসে দেখি পুলিশের ব্যারিকেড। ভিতরে যাত্রীবাহী কোন যানবাহন ঢুকতে দিচ্ছে না। তারাকান্দিতে এসে আবার সেই ব্যারিকেড পেলাম। এভাবেই যানবাহন পরিবর্তন করে শেরপুর হাজীর মোড়ে এসে পোঁছলাম।
ভাল লাগলে শেয়ার করুন
- Click to share on Facebook (Opens in new window)
- Click to share on Twitter (Opens in new window)
- Share on Skype (Opens in new window)
- Click to share on Google+ (Opens in new window)
- Click to share on WhatsApp (Opens in new window)
- Click to share on Telegram (Opens in new window)
- Click to share on LinkedIn (Opens in new window)
- Click to share on Pocket (Opens in new window)
- Click to email this to a friend (Opens in new window)
- Click to print (Opens in new window)