সুফীবাদ-পীরবাদ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদ “একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ : পর্ব-০১
লোকমান হোসাইন:
পে-ইয়া-রে “পীর” নামক শব্দটি একটি ফার্সি শব্দ। ইহা কোন অবস্থাতেই আরবী শব্দ নয়। আবার কোরআন-হাদিসের পরিভাষারও কোন শব্দ নয়। ফার্সি ভাষাভাষী দেশে যে কোন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা লোককে পীর বলে ডাকা হয়। আবার পারস্যের অগ্নীপূজারী গুরুকে বা পুরোহিত ব্যক্তিকে পীরে মুগা বলে ডাকা হয়। এর প্রমাণ ইতিহাস স্বাক্ষী। মুগ এর বহুবচন মুগা। মুগার অর্থ অগ্নীপূজারীগন। আর পীরে মুগা অর্থ অগ্নীপূজারীদের পীর। যা ফার্সি অভিধানে এরকম অর্থই করা হয়েছে। অগ্নীপূজারীগন মুগাদের পীর বলে ডেকে থাকে। ইতিহাসে আরও জানা যায়, রাজা-বাদশাদের পানশালার মদ বিক্রেতা পরিবেশনকারীকেও পীর বলে ডাকা হয়। তথাকথিত সূফীবাদীরা আধ্যাত্মিকতার প্রেমকে রূপক ভাবে মদ বলে অভিহিত করে থাকেন। অর্থ্যাৎ প্রেমরস পরিবশেক বা পীর। বর্তমানে যে ভাবে পীরের অর্থ করা হয় ওস্তাদ, শিক্ষক, আলেম, জ্ঞানী ইত্যাদি এটি একটি কাল্পনিক অর্থ। খ্রিষ্টানদের প্রিষ্ঠ, হিন্দুদের পুরোহিত, বৌদ্ধদের ভিক্ষু বলতে যা বুঝায় পীর বলতে ঠিক তাই বুঝায়। ভাষার অভিধানে বিজ্ঞ আলেম, ইমাম, ওস্তাত, নেতা বা জগৎবিখ্যাত জ্ঞানী আলেমদের আল্লামা বা শায়খ বলে ডাকে। মধ্য প্রাচ্যের আরবী ভাষাভাষী দেশে শায়খ শব্দের প্রচলন আছে বটে। কিন্তু পীর শব্দের প্রচলন নাই। শুধুমাত্র ভারত উপমহাদেশেই পীরগীরি আস্তানা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে। আরবের হারাম শরীফের বিখ্যাত আলেমদের শায়খ বলে ডাকেন যেমন- শায়খ আব্দুর রহমান সুদাইসী, শায়খ আব্দুর রহমান হোজাইফী তারা কোরআন হাদিসের সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী। তারা তাওহীদ বা আল্লাহর একত্মবাদের অনুসারী ও প্রচারকারী। তারা শিরক ও বেদআতের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রামী। এই পীর শব্দটি কোরআন-হাদিসে নেই, যা ইতিপূর্বে বলেছি। রাসূল (স), সাহাবায়ে আজমাঈন, তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেঈনদের যুগে কেউ কোনদিন পীর বলে দাবী করেননি। যগৎ বিখ্যাত শায়খগনও কেউ কোনদিন পীর দাবী করেননি। প্রচলিত এই পীর নামক শব্দ ও ভাবধারা চিন্তাচেতনা কার্যাবলী ইসলামের পতন যুগের ইসলামী শক্রুদের ও কু-চক্রীদের সংযোজন মাত্র। এই তথাকথিত পীরেরা অসংখ্য মনগড়া তরীকা বা রাস্তা আবিস্কার করে বা উদ্ভাবন করে যেমন- কাদেরীয়া, চিশতীয়া, মোজাদ্দেদীয়া ইত্যাদি মুসলমান জাতিকে শতধা ধারায় বিভক্ত করে কৌশলে তাদের ধর্ম ব্যবসা নির্বিঘেœ চালিয়ে যাচ্ছেন। যারা কৃষিকাজ করেন তারা হলেন- কৃষিজীবি, যারা মৎস্য চাষ ও ব্যবসা করেন- তারা হলেন মৎস্যজীবি, যারা আইন ব্যবসা করেন- তারা হলেন আইনজীবি কিন্তু যারা ধর্মকে নিয়ে ব্যবসা করেন- তারা হলেন ধর্মজীবি। যখন কোন আলেম, জ্ঞানী, পীরগন, ইমাম সাহেবগন, স্বার্থপর-আত্মকেন্দ্রিক ও ধর্ম ব্যবসা করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে অভ্যস্ত তারাই ধর্মজীবি। আল্লাহপাক ধর্ম ব্যবসাকে হারাম ঘোষণা করেছেন (সূরা-বাকারা-১৭৪-১৭৫)।
তথাকথিত পীরদের নিয়ম-নীতি আর ব্রাহ্মণ, প্রিষ্ঠ, পৌরহিত্য ও ভিক্ষুদের নিয়ম-নীতি প্রায় একই সূত্রে গাথাঁ। হিন্দুদের ব্রাহ্মণদের বলা হয় বর্ণশ্রেষ্ঠ। ব্রহ্মার মুখ থেকে নাকি তাদের আবির্ভাব। সেহেতু পূজাপার্বণ, বিয়েসাধী থেকে শুরু করে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণরাই পৌরহিত্য করে থাকেন। পুরো অর্থ অগ্রে, হিত অর্থ মঙ্গলকার্যে। সবার আগে নাকি ব্রাহ্মণরাই থাকবে, ব্রাহ্মণরাই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রধান। ব্রাহ্মণ মারা গেলে তার ছেলেই হবে ব্রাহ্মণ। এভাবে বংশানুক্রমে এই পৌরহিত্য বা ব্রাহ্মণগীরি চলতে থাকবে। শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা, চিন্তা-চেতনা ও চরিত্র থাকুক বা না থাকুক। ঠিক একই ভাবে তথাকথিত পীরের বংশের ধারাবাহিকতা পীরের বংশের সবাই যেন পীর। বড় পীর, ছোট পীর, মেঝো পীর, সেজো পীর, এ যেন পীরের হাট-বাজার। আবার পীর সাহেবদের ছেলেমেয়েরা সমাজে পরিচিত হন পীরজাদা, পীরজাদী বলে। পীর সাহেব যদি ইন্তেকাল করেন তবে তার ছেলেই হয়ে যাবেন পীর বা গদ্দীনিশীন পীর। পীর সাহেবের মৃত্যুর পূর্বে যদি ওছিয়ত করে যান, আমার মৃত্যুর পর অমুক ছেলে হবেন পীর তবুও দেখা যায় একাধিক পুত্রের মধ্যে লেগে যায় দলাদলী, মারামারি, কাটাকাটি, প্রতিহিংসা। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় মামলা-মোকাদ্দমা। অনেক ক্ষেত্রে একাধিক পীরজাদারা এলাকা ভাগাভাগি করে পীরগীরি ধর্ম ব্যবসা চালিয়ে যান। যদি পীর সাহেবের ছেলে সন্তান না থাকেন তবে ভাই বা জামাতা হবেন পীর সাহেব বা গদ্দীনিশীন পীর। এ যেন পীরের জমিদারী বা ওয়ারীশি নিয়ে টানাটানি। জ্ঞান-বিদ্যা, আমল-আখলাক চাই থাকুক বা না থাকুক নাই বা থাকুক তার ঈমান-আকীদা, নাই বা হোক সে মোমেন। আল্লাহর একত্ববাদের তো প্রশ্নই উঠে না। পীরের ঔরষে জন্ম, পীরের গন্ধ তো তার শরীরে আছে ব্যস। ব্রাহ্মণের ছেলে হবে ব্রাহ্মণ আর পীরের ছেলে হবে পীর। পীরবাদ আর ব্রাহ্মণ্যবাদ এদের কি সুন্দর অপূর্ব মিল! ইসলামে কোন পীরের বা আলেমের তথাকথিত পীরদের পৌরহিত্য করার একক অধিকার নাই। আল্লাহ বলেন, সেই পথে তীব্র গতিতে চল যা তোমার রবের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে চলে গিয়েছে, যার প্রস্ততা আকাশ ও পৃথিবী ব্যাপী এবং যা আল্লাহ ভীরু লোকদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে (সূরা-আল ইমরান-১৩৩)। মুসলমানগন প্রত্যেকেই প্রত্যেকের পৌরহিত্য। আফ্রিকার কালো বেলালই হোক আর ক্রিতদাস যায়েদই হোক না কেন জ্ঞানে ও আল্লাহর একত্ববাদে যে শ্রেষ্ঠ সেই তার নিজেই পৌরহিত্য। এখানে কোন বর্ণ শ্রেষ্ঠ নাই (চলমান)
বি:দ্র- মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নহে।
ভাল লাগলে শেয়ার করুন
- Click to share on Facebook (Opens in new window)
- Click to share on Twitter (Opens in new window)
- Share on Skype (Opens in new window)
- Click to share on Google+ (Opens in new window)
- Click to share on WhatsApp (Opens in new window)
- Click to share on Telegram (Opens in new window)
- Click to share on LinkedIn (Opens in new window)
- Click to share on Pocket (Opens in new window)
- Click to email this to a friend (Opens in new window)
- Click to print (Opens in new window)