সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা কে দিবে ?

তালাত মাহমুদ : আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বন্ধু গো বড় বিষজ্বালা এই বুকে, দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই কই যাহা আসে মুখে’। দুর্নীতিবাজ আমলা, মুনাফাখোর অসাধু ব্যবসায়ী এবং লুটেরাদের কাছে আমরা আজ জিম্মি। দুর্নীতিবাজদের মূল শিখর এত গভীরে প্রোথিত যে, তার ক‚লকিনারা পাওয়া যায়না। এদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করতে গেলে সাংবাদিকদের নানা হুমকী ধমকীর শিকার হতে হয়। এদের রয়েছে দুর্ধর্ষ ক্যাডার বাহিনী। সাংবাদিকদের খুন করে গুম করতেও এরা দ্বিধা করবে না।
দুর্নীতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। নরাইল জেলা প্রশাসকের কার্য়ালয়ের চার পিয়ন কয়েক বছরে প্রত্যেকে কোটিপতি হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক নাইট গার্ড কয়েক কোটি টাকার মালিক। এধরণের চাঞ্চল্যকর সংবাদ আমরা হরহামেশাই দেখতে পাচ্ছি। দুদকের অভিযোগের তালিকায় আছে এমন অনেক রাঘব বোয়াল জাল ছিড়ে বেরিয়ে আসছে। হলমার্কস, পাপিয়া, শামীম, ফারুক, গোল্ডেন মনির, পিকে হাওলাদারÑ এদের কথা এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।
সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলো’র সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনা বেগমকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসা সচিবালয়ে ডেকে নিয়ে তার কার্যালয়ে ৬ ঘন্টা আটক রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে রাত সাড়ে ৮টার দিকে পশাহবাগ থানা পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এঘটনায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে এমনকি জাতিসংঘ থেকেও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
এদিকে সাংবাদিক রোজিনা বেগমকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৯ মে বুধবার বেলা ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত জাতীয় প্রেসক্লাব চত্বরে মানববন্ধন করেছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ), রংপুর বিভাগ সাংবাদিক সমিতি, বরিশাল ডিভিশন জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন। বিএফইউজের সভাপতি মোল্লা জালাল ও মহাসচিব আবদুল মজিদ, ডিইউজের সাবেক সভাপতি আবু জাফর সূর্য, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার, বিএসআরএফের সভাপতি তপন বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ ছাড়াও অন্যান্য সাংবাদিক নেতা বক্তব্য দেন।
মানববন্ধনে বিএসআরএফের সভাপতি তপন বিশ্বাস বলেন, রোজিনা ইসলামকে নির্যাতন করা হয়েছে। তাঁকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে ছোট একটি অভিযোগ দিতে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ছয়টি ঘন্টা সময় লেগেছে কেন? কী এমন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ফাইল চুরি করেছেন তিনি? যদি এতই রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ফাইল হয়ে থাকে তবে তা নিরাপদে না রেখে সচিবের পিএসের টেবিলে পড়েছিল কেন? সাংবাদিক নেতারা বলেন, রোজিনা ইসলামের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত এধরণের কর্মসূচী চলতে থাকবে।
প্রথম আলোর সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম গ্রেফতারের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘের মুখপাত্র ডুজারিক বলেন, আমরা বাংলাদেশে সাংবাদিক গ্রেফতার নিয়ে প্রেস রিপোর্ট দেখেছি। এটি একটি উদ্বেগজনক বিষয়। হয়রানি বা শারীরিক নির্যাতন ছাড়া পৃথিবীর সব দেশে সাংবাদিকদের দায়িত্ব স্বাধীনভাবে পালনের প্রয়োজন রয়েছে। এবিষয়ে আমাদের অবস্থান পরিস্কার।
গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির গোমর ফাঁস করায় সাংবাদিক রোজিনার বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দেওয়া হয়েছে। তিনি রোজিনা ইসলামকে গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে তার মুক্তি এবং রোজিনা ইসলামকে হেনস্তাকারী অতিরিক্ত সচিবসহ জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানান। একই দাবী জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতি সাদিকুর রহমান হিরু এক বিবৃতিতে রোজিনা ইসলামের গ্রেফতারের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে তার মুক্তি দাবী করেছেন।
এছাড়া অবিলম্বে রোজিনা ইসলামের মুক্তিদাবী করেছেন গণতান্ত্রিক বামঐক্য, সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, সমাজতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি) সহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন।
এদিকে সারাদেশের সাংবাদিকরা রোজিনা ইসলামের নিঃশর্ত মুক্তিদাবীতে রাস্তায় নেমে আসেন। তারা জেলায় জেলায় এমনকি উপজেলাগুলোতেও মানববন্ধনের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানান এবং দুর্নীতিবাজদের বিচার দাবী করেন।
১৭ মে সোমবার রাতে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপ-সচিব শিব্বির আহমেদ উসমানী কর্তৃক দায়েরকৃত অফিসিয়াল সিক্রেটস এ্যক্টের মামলায় রোজিনা ইসলামকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। মামলাটির তদন্তভার পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়েছে। ১৯ মে বুধবার ডিবির রমনা অঞ্চলের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মিশু বিশ্বাস সাংবাদিকদের জানান, মামলাটি আমাদের কাছে এসেছে। আমরা তদন্তভার পেয়েছি। যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত করব।
প্রথম আলোর সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনা বেগমের নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে ১৯মে বৃহজস্পতিবার শেরপুর প্রেসক্লাবের মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ প্রেসক্লাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি মলয় মোহন বলের সভাপতিত্বে প্রেসক্লাব প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোঃ মেরাজউদ্দিনের সঞ্চালনায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সহ-সভাপতি মোঃ শহীদুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আদিল মাহমুদ উজ্জল, সাংগঠনিক সম্পাদক মানিক দত্ত, কার্যনির্বাহী সদস্য ও শ্যামলবাংলা২৪ডটকম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম আধার, কার্যনির্বাহী সদস্য সাবিহা জামান শাপলা, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি রাজিয়া সামাদ ডালিয়া, কবি সংঘ বাংলাদেশ এর সভাপতি কবি ও সাংবাদিক তালাত মাহমুদ, প্রথম আলোর শেরপুর জেলা প্রতিনিধি দেবাশীষ সাহা রায়, জনউদ্যোগের আহŸায়ক আবুল কালাম আজাদ, ইয়ং রিপোর্টার্স ইউনিটের সভাপতি মোঃ জাহিদুল খান সৌরভ, নালিতাবাড়ী প্রেসক্লাব সভাপতি এম এ হাকাম হীরা, নকলা প্রেসক্লাব সভাপতি মোঃ মোশারফ হোসাইন, মহিলা পরিষদ নেত্রী আইরিন পারভীন সহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
প্রথম আলোর সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনা বেগমের নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে বিভিন্ন বক্তা জোরালো বক্তব্য দেন। আমি আমার বক্তব্যে আমাদের কষ্টের কথা বলেছি, আমাদের পেশাগত নিরাপত্তাহীনতার কথা বলেছি। আমাদের (সাংবাদিকদের) প্রতি আমলাদের দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেছি। আমাদের ক্ষোভগুলো সাহসী উচ্চারণের মাধ্যমে তুলে ধরেছি। দর্শক শ্রোতার মূর্হুমূহু করতালি প্রমাণ করে আমার কথাগুলো যুক্তিসংগত ছিল।
২০মে বৃহস্পতিবার নকলা প্রেসক্লাব আয়োজিত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ মোঃ মোশারফ হোসাইনের সভাপতিত্বে নকলা থানার সামনে অনুষ্ঠিত হয়। সহ-সভাপতি খন্দকার জসিমউদ্দিন মিন্টুর সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন কবি সংঘ বাংলাদেশ এর সভাপতি কবি সাংবাদিক ও কলামিস্ট তালাত মাহমুদ, প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন সরকার (বাবু), সম্মানিত সদস্য আলহাজ্ব মাহবুবর রহমান, সম্মানিত সদস্য আব্দুর রফিক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাছিরউদ্দিন ও দেলোয়ার হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ নূর হোসেন ও রাজন এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রিজন সহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
নকলা প্রেসক্লাব আয়োজিত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে আমি (এই নিবন্ধের লেখক) বলেছি, সাংবাদিক রোজিনা বেগম একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক। একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিককে বিভিন্ন কৌশলে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়। তাই বলে তাকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল চুরি করতে হবে (?) এ কেমন কথা? সাংবাদিকরা দেশের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেনা। সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়না। সরকারের এত উন্নয়ন কর্মকান্ডের সংবাদ-চিত্র সাংবাদিকরাই টিভিতে, সংবাদপত্রে তুলে ধরেন। গণমাধ্যম তো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সাংবাদিকতার নীতিমালা রয়েছে। সাংবাদিকদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ রয়েছে। তারা নিবেদিতপ্রাণ, তারা দেশপ্রেমিক। মিথ্যে মামলা দিয়ে, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে মনের ক্ষোভ মিটানো যায় বটে। কিন্তু পার পাওয়া যায়না।
ফেসবুক সুবাদে জানা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুস্বাস্থ্য বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবন্নেসা অঢেল ধন-সম্পদের মালিক। কানাডায় তার তিনটি বাড়ি রয়েছে, পূর্ব লন্ডনে একটি বাড়ি রয়েছে এবং ঢাকায় চারটি বাড়ি রয়েছে। গাজীপুরে রয়েছে ২১ বিঘা জমি। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে নামে বেনামে রয়েছে ৮০ কোটি টাকা। এসব তথ্য যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে একজন নারী আমলা যদি এত ধন-সম্পদ ও বিত্ত-বৈভবের মালিক হন তাহলে দুর্নীতিগ্রস্ত পুরুষ আমলারা কত সম্পদের মালিক? দেশের বাইরে ‘সেকেন্ড হোম’ কারা বানিয়েছে? কোটি কোটি টাকা কারা পাচার করেছে? এর প্রতিকার কেন হচ্ছেনা?
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ, আমাদের বাবা ভাই ও আত্মীয়স্বজনের ধন-সম্পদ আর অগণিত শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। কতিপয় দুর্নীতিবাজের জন্য স্বাধীনতাকে ¤øান হতে দেওয়া যায়না। অসির চেয়ে মসি অনেক শক্তিশালী। দুই হাতে কলম-অস্ত্র নিয়ে আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাব।
শেষকথা: মফস্বলের গণমাধ্যম কর্মীদের মাঝেও গিরিঙ্গিবাজ রয়েছে। এরা মূলত রাজনৈতিক কর্মী। সব জায়গায় মাতব্বরী ফলায়। আবার সমাজেরও কোন কোন শ্রেণি-পেশার মানুষ সাংবাদিকদের সহ্য করতে পারেনা। নিজেদের অবস্থান ভুলে গিয়ে সাংবাদিকদের পিছে লাগে। ভাবটা এমন যেন তাদের মত তুলশিশুদ্ধ আর একজনও নেই। এইসব মানুষের জন্য আমাদের করুণা হয়। তারা জানেনা, সাংবাদিকরা নিরীহ এবং শান্তিপ্রিয় মানুষ। তবে বাইজ্যা টেংরা মাছের মত ছোট। একবার কাঁটা বিধালে সারাজীবন মনে থাকে।
তালাত মাহমুদ: কবি সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং সভাপতি, কবি সংঘ বাংলাদেশ।
ভাল লাগলে শেয়ার করুন
- Click to share on Facebook (Opens in new window)
- Click to share on Twitter (Opens in new window)
- Share on Skype (Opens in new window)
- Click to share on Google+ (Opens in new window)
- Click to share on WhatsApp (Opens in new window)
- Click to share on Telegram (Opens in new window)
- Click to share on LinkedIn (Opens in new window)
- Click to share on Pocket (Opens in new window)
- Click to email this to a friend (Opens in new window)
- Click to print (Opens in new window)