সিটিসেলে চাকরিজীবীদের দুর্দিন, দেখার কেউ কি নেই?
গত বুধবার সিটিসেলের প্রধান কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করেছে সেখানকার কর্মরত চাকরিজীবীরা। গণমাধ্যমে খবরটি প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রচারিত হয়েছে। সিটিসেল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এই সংবাদ বেশ কিছুদিন আগের। যারা একসময় সিটিসেল ফোন ব্যবহার করেছেন, খবরটা পড়ে তারা একটু নস্টালজিক হয়েছিলেন কয়েক মুহুর্তের জন্য।
এই মুহূর্তে সিটিসেলের গ্রাহক সংখ্যা মাত্র কয়েক লাখ, সুতরাং এই কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যাবেই। আজকের অবস্থার জন্য কারা দায়ী এই প্রশ্ন করে লাভ নেই, কারণ এইসব প্রশ্নের উত্তর আসলে কেউই দেয় না, দিবে এই সম্ভাবনাও কম।
সরকারের টাকা পাওনা কয়েকশ কোটি, সিটিসেল যা দেয় নি বা দিতে পারছে না; সুতরাং সরকার সেটি বন্ধ করে দিবে এটা খুব স্বাভাবিক একটি ভাবনা।
সিটিসেলের কাছে চাকুরিজীবীদের বেতন-ভাতাদি পাওনা আছে। সিটিসেলে চাকুরি করতে গিয়ে জীবনের সোনালি দিনগুলি হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট আছে। অনেকে অন্য কয়েকটা চাকুরি পেয়েও সিটিসেলেই থেকে যাওয়ার আফসোস আছে। এইরকম অনেক মানবিক টানাপোড়েন আর কষ্টের কথা নাই বা বললাম।
দেনা-পাওনাই ব্যবসার মূল বিষয়। মুনাফার জন্যই ব্যবসায়ী ব্যবসাটা করে। চাকুরিজীবীরা বেতনের বিনিময়ে শ্রম দেয়। সিটিসেলও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম না। একসময় লাখ টাকা দিয়ে সিটিসেলের একটা সংযোগ কিনতে হয়েছে। ক্ষমতার অপপ্রয়োগের মাধ্যমে একচেটিয়া ব্যবসার মজা একদা পুরোটাই উপভোগ করেছে সিটিসেলের মালিকপক্ষ। যখন সিটিসেলের এই একচেটিয়া মোবাইল ফোনের ব্যবসা ছিলো, তখন কিন্তু মালিক পক্ষ একমাস কাজ করলে চারমাসের বেতনের সমান টাকা দেয়নি একজন চাকুরিজীবীকে।
এখন সিটিসেলের ব্যবসা খুব খারাপ। কিন্তু চাকুরিজীবীরা মাসের পর মাস বেতন পাবে না কেন? চাকুরিজীবীদের দায় বা দোষটা কি? এখানে চাকুরি করাটাই কি এদের অপরাধ? ব্যবসা খারাপ, এই যুক্তিতে যদি বেতন না দেয়াটা জায়েজ হয়; তবে তো যারা ভালো ব্যবসা করছে তারা একমাস কাজ করিয়ে ৪ (চার) মাসের বা চারগুণ বেতন দেয়া উচিত।
গতকাল (বুধবার) রাত ৯ টার সংবাদে ৭১ টেলিভিশনে সিটিসেলের প্রস্তাবিত ইউনিয়নের সভাপতির কণ্ঠস্বর শুনলাম। অসম্ভব বিনয়ের সাথে বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করলেন তিনি।
তিনি বললেন, “কোথায় যাব, কার কাছে বলবো কিছুই বুঝতে পারছিনা?”
আসলে আমরা কেউই জানি না বাংলাদেশের এই ৬৫০ জনের মতো চাকুরিজীবী কোথায় গেলে পরিত্রাণ পাবে? তাই একান্ত বাধ্য হয়েই বোধহয় তাঁরা রাস্তায় নেমে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে, যদি কেউ শুনে!
সিটিসেলের চাকুরিজীবীরা মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানুষ। একটা পোষাকি ভালো থাকার ভান এঁদের এতদিন করতে হয়েছে। কিন্তু বাড়ি ভাড়া দিতে না পারা, বাচ্চার স্কুলের বেতন দিতে না পারা আর প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে না পারাই আজকে এঁদের বাধ্য করেছে অফিসের সামনের রাস্তায় সমাবেশ করতে।
বাংলাদেশে মালিক এবং শ্রমিকের ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা ব্যাপক এবং চূড়ান্ত রকম বিপরীতমুখী। ক্ষমতার সবটুকুই দৃষ্টিকটু ও প্রকটভাবে মালিকের হাতে। মালিকের অর্থ-বিত্ত, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা-বলয়ের সাথে পরিচয়ের ব্যাপ্তি আর ক্ষমতাকেন্দ্রের সাথে যোগাযোগের তুলনায় ক্ষমতা বলতে শ্রমিকের কিছুই থাকেনা। শুধু শরীর আর মেধার বিনিময়ে বেঁচে থাকতে পারলেই বর্তে যায় বাংলাদেশের শ্রমিক।
আমাদের দেশে ক্ষমতাকেন্দ্রের সাথে প্রান্তের মানুষের দূরত্ব যোজন যোজন। বাংলাদেশের ক্ষমতাকেন্দ্রের মানুষদের অত্যল্প সময়ে অত্যধিক আর্থিক উন্নতি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা সম্ভব। কী জাদুবলে উনাদের এমন বিত্ত-বৈভব তা জানা থাকা ভালো।
অন্যদিকে প্রান্তের মানুষেরও কিছুটা উন্নতি হয়েছে বৈকি। অসহায় মানুষ দলে দলে ঢাকা এবং আশেপাশের শহরে এসে পেটের দায়ে কিছু একটা কাজ জোগাড় করে নিয়েছে। প্রয়োজনের তাগিদেই বস্তিতে বা বস্তিসম কোন এক কামরার ঘরে সেইসব মানুষেরা একটা থাকার জায়গাও খুঁজে নিয়েছে। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ‘মানব সম্পদ’ শরীরটা নিয়েই কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছে বিভিন্ন দেশে। শুধু রয়ে গেছে কৃষক, যাঁরা এখনো ফসল ফলায় আত্মবিশ্বাসে।
গার্মেন্টস শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিক এবং কৃষকের উপর ভর করেই আমাদের বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশ। কিন্তু সেইসব প্রান্তিক মানুষের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থানের মতো মৌলিক বিষয়াদির নিশ্চয়তা আজ শুধু প্রশ্নবিদ্ধই না, বরং দিনের পর দিন ক্রমাগত উপেক্ষার ফলশ্রুতিতে তাদের সেই মৌলিক অধিকার আজ কার্যত অপ্রাসঙ্গিকতায় পর্যবসিত।
বিষয়টা একপেশে দৃষ্টি দিয়ে দেখতে চাই না, তাই স্বীকার করে নিতে চাই যে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে অনেকখানি। কাজের বুয়া পাওয়া যায় না বলে মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে হাস্যকর হা-হুতাশও আছে! একদিন হয়তো রিকশার মতো একটি অমানবিক যানও আর চালাবে না কেউ পেটের দায়ে।
কিন্তু কেন্দ্র এবং প্রান্তের যোগাযোগ নিবিড় না হওয়ায় এবং এই দুইয়ের মধ্যকার দূরত্ব বিরতিহীনভাবে বাড়তে থাকায়, সুশাসনের প্রশ্নটাই সমাজে আর থাকছে না। সবাই যেকোন মূল্যে টাকা কামাতে চাচ্ছে। টাকা দিয়েই কিনে নিতে চাচ্ছে নিশ্চিত পার্থিব এবং অপার্থিব ভবিষ্যৎ জীবন।
ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে, সিটিসেলের চাকুরিজীবীদের কি হবে? এই প্রশ্নের মীমাংসা করা জরুরি। সিটিসেল বন্ধ করবার আগেই সেটা করা দরকার। সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার যদি এগিয়ে না আসে, তাহলে সিটিসেলের চাকুরিজীবীদের পক্ষে মালিকপক্ষের সাথে পেরে উঠা প্রায় অসম্ভব। কারণ চারমাস ধরে বেতন না পাওয়া এইসব মানুষের পক্ষে কিইবা করার আছে!
আমরা চাই, সিটিসেলের চাকুরিজীবীদের পাওনাদি বুঝিয়ে দেওয়া হোক দ্রুত। যদি কোম্পানি বন্ধ করে দিতেই হয়, তাহলে যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ এবং বিকল্প কর্মসংস্থান করার পরেই শুধুমাত্র তা করতে হবে। আর এ ব্যাপারে আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হতে হবে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদেরই। বিটিআরসি, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, কিংবা শ্রম মন্ত্রণালয় সেই কাজটি করতে পারে। দায়বদ্ধতার কারণেই তাদের তা করা উচিত। সিটিসেলের চাকুরিজীবীদের এই দুর্দিনে সবাই এগিয়ে আসবেন এটিই কাম্য।
যে দেশে ভারত থেকে বানের পানিতে ভেসে আসা হাতির জন্য ভালাবাসার কাব্য রচিত হয়, সেই দেশে অপরিণামদর্শী, অন্ধ মুনাফার লোভের বলি বাংলাদেশের প্রথম মোবাইল কোম্পানি সিটিসেলের চাকুরিজীবীদের জন্য কেউ গান লিখবে না, কবিতা লিখবে না, পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হবে না, কেউ পাশে এসে দায়িত্ব নিবে না, তাই কি হয়?